Last Updated on May 30, 2024 by Shiksha Diksha
রাজা রামমোহন রায় (Raja Ram Mohan Roy)
রাজা রামমোহন রায় (Raja Ram Mohan Roy) বাংলা প্রবন্ধ রচনা (Bangla Probondho Rochona) সংগ্রহ করে দেওয়া হল। নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের বাংলা বিষয়ের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা হবে। [অনুসরণে লেখা যায়ঃ (১) ভারত পথিক রামমোহন রায়, (২) সার্ধ দ্বিশতবর্ষে রামমোহন রায়, (৩) ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূতের ২৫০ তম জন্মবার্ষিকী পালন।]
প্রবন্ধ সূত্র: ভূমিকা-প্রাথমিক পরিচয়- রামমোহন রায়ের ধর্মসংস্কার-সমাজসংস্কার ও রামমোহন, শিক্ষাসংস্কার ও রামমোহন, রামমোহন রায়ের সাহিত্যজীবন-বাংলা গদ্যে রামমোহন- সাংবাদিকতায় রামমোহন-উপসংহার।
এক নজরে
► ভূমিকা:
উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের সমকালীন সময়ে যেসব মনীষী আধুনিক চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটান এবং সামাজিক কুসংস্কার ও কূপমণ্ডুকতার অবসানেও অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন রামমোহন রায় তাঁদের অগ্রগণ্য। তাঁকে ‘ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত’ বলা হয়। ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতীয় সমাজের অধোগতি দূর করে সমাজে সংস্কারের স্বপ্নে বিভর ছিলেন তিনি। তাঁকে ‘ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’, ‘আধুনিক ভারতের ইরাসমাস’, ‘আধুনিক ভারতের জনক’ ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করা হয়। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবরের কাছে তিনি ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেন। ২০২২ খ্রিস্টাব্দে এই বিশিষ্ট মনীষীর জন্মের ২৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাই তাঁকে বিশেষ রূপে স্মরণ করা উচিত।
▶ রাজা রামমোহন রায়ের (Raja Ram Mohan Roy) প্রাথমিক পরিচয়:
১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের ২২ মে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে রামমোহন রায়ের জন্ম হয়। পিতা রামকান্ত, মাতা তারিণী দেবী। রামমোহনের পিতৃকূল ছিল নিষ্ঠাবান বৈম্নব, কিন্তু তাঁর মাতৃকূল শান্ত। পিতামাতার এই ধর্মবিশ্বাসের চেতনা রামমোহনকে ধর্মের তাৎপর্য অনুসন্ধান করেছিল। তিনি আরবি ও ফারসি শেখার মাত্র জন্য নয় বছর বয়সে পাটনা যান। শিক্ষা সমাপনান্তে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার উদ্দেশ্যে কাশী গমন করেন। এই তিনটি ভাষা শিক্ষার ফলে তিনি ভারতীয় ব্রহ্মবাদ এবং ইসলামের একেশ্বরবাদের দ্বারা প্রভাবিত হন। বাংলাদেশের রংপুরের কালেক্টর জন ডিগবির কাছে কাজ করার সময়ে ইংরেজি শাসনকার্যের ভাষা হওয়াতে অল্পসময়ে তিনি ইংরেজনবিশ হয়ে ওঠেন। এ ছাড়া স্বগ্রামের নিকটবর্তী পালপাড়া গ্রামের নন্দকুমার বিদ্যালংকার বা হরিহরানন্দ তীর্থস্বামীর সংস্পর্শে শৈশবেই তাঁর মনে আধ্যাত্মিকতার বীজ রোপিত হয়। ফ্রান্সিস বেকন, লক, হিউম, ভলতেয়ার, নিউটন, টম পেইন প্রমুখ পাশ্চাত্য মনীষীর চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ফলে তিনি যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদীও হয়ে ওঠেন।
▶ রামমোহন রায়ের (Raja Ram Mohan Roy) ধর্মসংস্কার:
হিন্দু সমাজের আচার সর্বস্বতা, পৌত্তলিকতা, পুরোহিততন্ত্র, কুসংস্কার ইত্যাদি রামমোহনকে ব্যথিত করে। তাই বেদান্তকে অবলম্বন করে তিনি সমাজসংস্কারে প্রবৃত্ত হন, এর দ্বারা তিনি হিন্দুধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা তথা খ্রিস্টান-মিশনারিদের আক্রমণ থেকে এই ধর্মের রক্ষায় অনুপ্রাণিত হন। তিনি হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতা, লোকাচার সর্বস্বতা ব্যতিরেকে একেশ্বরবাদ ও নিরাকার ব্রশ্নের উপাসনার কথা প্রচার করতে থাকেন। এই উদ্দেশ্যে ‘তুহাফৎ উল-মুয়াহিদ্দিন’ বা ‘একেশ্বরবাদীদের প্রতি’ (১৮০৩) নামক একটি পুস্তিাকাও লেখেন। বাংলা ভাষায় বেদান্তের ভাষ্য ও পাঁচটি প্রধান উপনিষদের বঙ্গানুবাদও (১৮১৬-১৯) রচনা করেন। নিজের উদ্দেশ্যকে সফলকাম করতে ১৮১৫-তে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘আত্মীয় সভা’ যেখানে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা হত। একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য ১৮২৮ মতান্তরে ১৮২৯-এ প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্মসভা যা ১৮৩০-এ ব্রাহ্মসমাজ নাম ধারণ করে।
আরও দেখুনঃ প্রযুক্তির আক্রমণে বিপর্যস্ত পরিবেশ: বাংলা প্রবন্ধ রচনা | Bangla Prabandha Rochana
▶ সমাজ সংস্কার ও রামমোহন:
জাতির নবজীবনে এক দরদি বাস্তববাদী সংস্কারক রূপে রাজা রামমোহন রায় জাতপাত, অস্পৃশ্যতা, বর্ণ প্রথা, পুরোহিত, প্রাধান্য, সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন ইত্যাদির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। সামাজিক বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে জাতিধর্মবর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ উচ্চনীচ নির্বিশেষে এক সুস্থ সাম্যবাদী সমাজগঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তৎকালীন হিন্দু সমাজের সর্বাপেক্ষা মর্মান্তিক কুপ্রথা হল সহমরণ বা সতীদাহপ্রথা। ১৮১৮-তে প্রথম এই প্রথার বিরুদ্ধে রামমোহন প্রতিবাদ জনমত গঠন শুরু করেন। বাংলা-ইংরেজি বিভিন্ন পুস্তিকাসহ ‘সম্বাদ কৌমুদী’ (১৮২১) পত্রিকায় বিবিধ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন সতীদাহ কতখানি অশাস্ত্রীয় ও ধর্মবিরুদ্ধ তা প্রমাণের জন্য। শুধু তাই নয় বাংলার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্বাক্ষরিত এই কুপ্রথা বন্ধের একটি আবেদনপত্র তিনি বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিষ্কের কাছে জমা দেন এবং তারই মধ্যস্থতায় ১৮২৯-এর ৪ ডিসেম্বর রেগুলেশন আইন-XVII দ্বারা এই কুপ্রথা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। পিতৃসম্পত্তিতে কন্যাদের পূর্ণ আইনগত অধিকার স্থাপনের জন্য তিনি যাজ্ঞবন্ধ্য ও ব্যাসস্মৃতি তুলে ধরে শাস্ত্রে এবং সম্পত্তিতে নারীর আইনগত অধিকারের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। জমিদারি অত্যাচার ও প্রজাপীড়নের বিরুদ্ধেও তিনি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
▶ শিক্ষাসংস্কার ও রামমোহন:
পাশ্চাত্যবাদী রামমোহন মনে করতেন জাতির সামগ্রিক উন্নতিতে পুথিগত জ্ঞান বা তাত্ত্বিকতার চেয়ে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, দর্শন, আইন, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতির ওপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া প্রয়োজন। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন বলে অনেকের অনুমান। নিজ ব্যয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাংলো হিন্দু কলেজ (১৮২২)। ১৮২৬-এ প্রতিষ্ঠা করেন বেদান্ত কলেজ যেখানে সমাজবিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষা দেওয়া হত। ডেভিড হেয়ারের শিক্ষাবিস্তারের কাজে, আলেকজান্ডার ডাফের জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন (১৮৩০) প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রধান সহায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি স্কুল বুক সোসাইটিরও সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৮২৩-এ ইংরেজ সরকার সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করলে তিনি এর বিরোধিতা করে লর্ড আর্মহার্স্টের কাছে একটি চিঠি লেখেন যাতে ‘ভারতবাসীর জন্য পাশ্চাত্য গণিত, প্রকৃতি বিজ্ঞান, রসায়ন, পাশ্চাত্য দর্শন, ইংরেজি ভাষা শিক্ষা প্রদানের দাবি জানান। এই পত্রটি ভারতের নবজাগরণের এক নির্ভরযোগ্য দলিল।
আরও দেখুনঃ পরিবেশ সুরক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকাঃ বাংলা প্রবন্ধ | Bangla Probondho Rochona
▶ রামমোহন রায়ের (Raja Ram Mohan Roy) সাহিত্য জীবনঃ
রামমোহন রায়ের সাহিত্য জীবন প্রধানত উনিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশক জুড়ে বিস্তৃত। কলকাতায় বাস করার সময় বাংলাদেশে বেদান্তচর্চার ক্ষীণ অবস্থা দেখে তিনি ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ‘বেদান্তগ্রন্থ’ রচনা করেন।
এ ছাড়াও তিনি লেখেন ‘বেদান্ত সার’ (১৮১৫), ‘ভট্টাচার্যের সহিত বিচার’ (১৮১৭), ‘গোস্বামীর সহিত বিচার’ (১৮১৮), ‘কবিতাকারের সহিত বিচার’ (১৮২০), ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’ (১৮২১), ‘ব্রাহ্মণ ও মিসনারি সম্বাদ’ (১৮২১), ‘চারি প্রশ্নের উত্তর’ (১৮২২), ‘পাদরি ও শিষ্য সম্বাদ’ (১৮২৩), ‘গুরু পাদুকা’ (১৮২৩), ‘প্রার্থনাপত্র’ (১৮২৩), ‘ব্রহ্মোপাসনা’ (১৮২৮), ‘অনুষ্ঠান’ (১৮২৯)। একেশ্বরবাদের স্বপক্ষে রামমোহনের প্রথম রচনা ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ ও ‘বেদান্ত সার’ সমকালে বিপুল আলোড়ন তুলেছিল। এই দুটি গ্রন্থকে রামমোহনের প্রথম মৌলিক বিতর্কমূলক বাংলা প্রবন্ধ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। এ ছাড়া কুসংস্কার ও প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েও তিনি বেশ কিছু বিতর্ক ও প্রতিবাদমূলক প্রবন্ধ লেখেন। যথা- ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ (১৮১৮), ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ’ (১৮১৯), ‘সুব্রষ্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার’ (১৮২০), ‘পথ্যপ্রদান’ (১৮২৩), ‘সহমরণ বিষয়’ (১৮২৩), ‘কায়স্থের সহিত মদ্যপান বিষয়ক বিচার’ (১৮২৬), ‘ব্রহ্মনিষ্ঠ গৃহস্থের লক্ষণ’ (১৮২৬)। শুধু বাংলা নয়, ইংরেজিতেও তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। প্রথম যৌবনে তিনি একটি ফারসি গ্রন্থ লিখেছিলেন যা ছিল একেশ্বরবাদের প্রচারমূলক রচনা। বাংলা গদ্যকে যথার্থ রূপ দেওয়ার জন্য তিনি ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ নামক একটি বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন। এটিই বাঙালি রচিত প্রথম বাংলা ব্যাকরণ।
▶ বাংলা গদ্যে রামমোহন:
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের গদ্যচর্চার পরে বাংলা গদ্যে প্রথম দৃঢ়তা এনেছিলেন রামমোহন রায়। রবীন্দ্রনাথের মতে, তিনি গ্রানাইট শিলার ওপর রচনা গদ্যকে স্থাপন করেছিলেন। তর্কবির্তকের মধ্য দিয়ে রামমোহন বাংলা গদ্যকে করেছেন শানিত ও ব্যবহারিক। বাস্তবতা, যুক্তিনিষ্ঠা, পার্থিব ও অপার্থিব চিন্তা-চেতনার মধ্য দিয়ে রামমোহন বাংলা গদ্যে যে ভারবহন ক্ষমতা এনে দিয়েছিলেন,
তা অনেকখানি ত্রুটিমুক্ত।
▶ সাংবাদিকতায় রামমোহন:
ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র রামমোহনকে ‘ভারতীয় সাংবাদিকতার অগ্রদূত’ বলা হয়। তিনি বাংলা ভাষায় ‘সম্বাদ কৌমুদী’ (১৮২১) পত্রিকা এবং ফারসিতে ‘মিরাৎ-উল-আকবর’ (১৮২২) পত্রিকা প্রকাশ করেন। ইংরেজ সরকার কর্তৃক সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রোধের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ জানান এবং সুপ্রিমকোর্ট ও ইংল্যান্ডের রাজার কাছে স্মারকলিপিও পাঠান।
▶ উপসংহার :
পাশ্চাত্য চিন্তায় প্রতিভাবান রাজা রামমোহন রায়ই আধুনিক ভারতের প্রথম পথিকৃৎ। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বরেণ্য পুজারি হিসেবে তিনিই ‘ভারতের আধুনিক মানুষ’ তথা নবযুগের প্রবর্তক। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ২৭ সেপ্টেম্বর সুদুর ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরে তাঁর জীবনবাতি নির্বাপিত হয়। উনিশ শতকের নবজাগরণের মূর্ত প্রতীক হিসেবে, পুরুষাকারের জীবন্ত প্রতীক হিসেবে, সমাজসংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায় আমাদের মাঝে অমর হয়ে থাকবেন। শুধু এই ২৫০ বছর পরেই নয় আগামী আরও ২৫০ বছর পরেও তাঁর অবদান একইভাবে স্মরণীয় থাকবে।
আমাদের পোষ্টের লেটেস্ট আপডেট পেতে আমাদের Whatsapp Channel জয়েন করুন এবং Telegram Channel জয়েন করুন।
Latest posts:
- পশ্চিমবঙ্গ নবম শ্রেণীর নতুন সিলেবাস | WBBSE Class 9 Syllabus
- নবম শ্রেণীর ইংরেজী সিলেবাস | Class 9 English Syllabus
- Layer-2 Admit Card 2024 | বিদ্যাসাগর সায়েন্স অলিম্পিয়াড ২০২৪
- ঐক্যশ্রী স্কলারশিপ ২০২৪ আবেদনের শেষ তারিখ, যোগ্যতা | Aikyashree Scholarship 2024
- NMMS Scholarship 2024 | আবেদনের পদ্ধতি, পরীক্ষার তারিখ